শিল্পী মুকেশের কণ্ঠে ও রাজকাপুরের অভিনয়ে “আওয়ারা হুঁ, ইয়া গরদিস মে হুঁ আসমান কা তারা হুঁ” গানটি শোনেননি এমন সঙ্গীত প্রেমিক কমই পাওয়া যাবে। গানের কথা না বোঝার বয়স থেকে শুনে আসছি।

তখন যেমন জনপ্রিয় ছিল, এখনো একই ধরনের জনপ্রিয় হিসেবেই রয়ে গেছে গানটি। এ গানের গীতিকার শৈলেন্দ্র, যার পুরো নাম শঙ্করদাস কেশরীলাল।

শৈলেন্দ্র’র জনপ্রিয় গানের সংখ্যা অনেক এবং বলিউডের মুভিতে তাঁর লেখা গানের বৈশিষ্ট হচ্ছে গানগুলোর অধিকাংশ গেয়েছেন শিল্পী মুকেশ এবং মুভিতে ঠোঁট মিলিয়েছেন রাজকাপুর। মুভিগুলোতে গানের দৃশ্যগুলো দেখেও মনে হবে মুকেশের কণ্ঠে ও রাজকাপুরের অভিনয়ের সঙ্গে গানগুলো অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। “সাজন রে ঝুট মাত বলো, খুদা কে পাস জানা হ্যায়/না হাথি (হাতি) হ্যায় না ঘোড়া হ্যায়, ওহা পায়দল হি জানা হ্যায়” (হে প্রিয়, মিথ্যা বলো না, আল্লাহর কাছে যেতে হবে/হাতি-ঘোড়া কিছু থাকবে না, ওখানে হেঁটেই যেতে হবে), অথবা “মেরা জুতা হ্যায় জাপানি, ইয়ে পাতলুন ইংলিস্তানি/সের পে লাল টোপি রুসি (রুশ) ফিরভি দিল হ্যায় হিন্দুস্থানি” (আমার জুতা জাপানের, এই প্যান্ট ব্রিটেনের/মাথায় রাশিয়ার লাল রঙয়ের টুপি, তবুও আমার হৃদয় একজন হিন্দুস্থানির)। অভিনয়ে রাজকাপুরের সাফল্যের পেছনে শৈলেন্দ্রে’র লেখা গানের অবদান অনেকখানি। রাজকাপুর শৈলেন্দ্রকে বিখ্যাত রুশ কবি আলেকজান্ডার পুশকিনের সঙ্গে তুলনা করে ‘পুশকিন’ বলে ডাকতেন। অনেকসময় তাঁকে ‘কবিরাজ’ নামেও সম্বোধন করতেন।

শৈলেন্দ্র’র ওপর ব্রিজ ভূষণ তিওয়ারি তাঁর ‘গীতোঁ কে সওদাগর’ গ্রন্থে লিখেছেন, “রাজকাপুর গান লেখার জন্য উপযুক্ত সম্মানী দেওয়ার কথা বললে এই ‘বিদ্রোহী-কাম-স্বেচ্ছাচারী গীতিকার’ উত্তর দেন: ‘আমি অর্থের জন্য লিখি না। আপনার মুভির জন্য একটি গান লিখতে আমাকে অনুপ্রাণিত করার মতো কোনো কারণ নেই ঘটেনি। তাহলে আমি লিখবো কেন?’”

১৯২৩ সালে শৈলেন্দ্র’র জন্ম অবিভক্ত ভারতের রাওয়ালপিণ্ডিতে। তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন বিহারের। রাওয়ালপিণ্ডি থেকে তাঁর পরিবার মথুরায় চলে আসে এবং সেখানে কিশোরী রমন স্কুলে পড়াশোনা করার সময় হিন্দি কবি ইন্দ্র বাহাদুর খারে’র সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘটে এবং এক পুকুর পাড়ে পাথরের ওপর বসে তিনি নিয়মিত কবিতা চর্চা শুরু করেন। শৈলেন্দ্র’র শৈশব কাটে দারিদ্রের মধ্যে। প্রথম যৌবনেই শৈলেন্দ্র মথুরা থেকে মুম্বাই চলে যান এবং সেখানে রেলওয়ে ওয়ার্কশপে ওয়েল্ডিং শিক্ষানবীশ হিসেবে কাজ শুরু করেন।

সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করার পরও কবিতার প্রতি তাঁর প্রেমে ভাটা পড়েনি। রেলওয়ে ওয়ার্কশপে কাজ করার সময়ই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক অঙ্গ সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান পিপল’স থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন’ (আইপিটিএ) এর সঙ্গে জড়িত হয়ে সংগঠনটির অনুষ্ঠানের জন্য অনেক কবিতা লেখেন ও আবৃত্তি করেন। এজন্য তাঁর অধিকাংশ কবিতায় সমাজতান্ত্রিক ও বামপন্থী প্রভাব সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। তবে সাদাত হাসান মান্টোর মত তিনি কখনও নিজেকে ‘প্রগ্রেসিভ রাইটার্স গ্রুপের অংশ হিসেবে বিবেচনা করেননি। শৈলেন্দ্র’র কবিতা ও গানের কথা তাঁর জীবনে দারিদ্রের সংগ্রাম ও যন্ত্রণারই প্রতিধ্বনি, ঠিক যেভাবে মির্জা গালিব লিখেছেন, “ম্যায় হুঁ আপনি শিকস্ত কি আওয়াজ,” (আমি তো আমার নিজের পরাজয়ের প্রতিধ্বনি)। তিনি হিন্দুদের বর্ণ-বিভাগের সর্বনিম্ন বর্ণ শূদ্র বা দলিত সম্প্রদায়ভূক্ত ছিলেন, কিন্তু জীবনে কখনও তাঁর দলিত পরিচিতি সম্পর্কে কিছু লিখেননি বা বলেননি।

গানের কথা যে অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে বলিউডের অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য। বলিউডের সূচনাকাল থেকে উর্দু ভাষা হিন্দি মুভির গানে প্রাধান্য বিস্তার করে এসেছে এবং ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও বলিউডের বহু মুভি কাহিনির চেয়ে উর্দু কবি সাহির সুধিয়ানভি, শাকিল বদাউনী, মাজরুহ সুলতানপুরি, কাইফি আজমি, জান নিসার আখতারের লেখা উর্দু গানেই অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। শৈলেন্দ্র উর্দু ও হিন্দি উভয় ভাষাতেই তাঁর গান ও কবিতা লিখেছেন এবং কবিতার ব্যবহৃত তাঁর ভাষার সরলতা, স্বত:স্ফূর্ততা, আবেগ এবং হৃদয়স্পর্শী কথা তিনি উপমহাদেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। চলচ্চিত্রের জগতে তিনি এতো বেশি সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন যে শৈলেন্দ্র’র কাব্য প্রতিভার চেয়ে তাঁর গানই বেশি আলোচিত হয়, কিন্তু তাঁর কবিতায়ও জীবনের বিভিন্ন দিকের প্রতিফলন ঘটেছে। মানুষের জীবন সংগ্রামকে তুলে ধরতে তাঁর ‘আওয়ারা হুঁ’ গানটিই যথেষ্ট।

আওয়ারা হু, ইয়া গরদিশ মে হুঁ, আসমান কা তারা হুঁ,
ঘরবার নেহি, সংসার নেহি, মুঝসে কিসি কো পিয়ার নেহি,
উস পার কিসি সে মিলনে কা ইকরার নেহি,
সুনসান নগর, আনজান ডগর কা পিয়ারা হুঁ
আওয়ারা হুঁ,
আবাদ নেহি বরবাদ সহি গাতা হু খুশি কে গীত মগর
জখমো সে ভরা সিনা হ্যায় মেরা হাসতি মগর ইয়া মাস্ত নজর,
দুনিয়া – দুনিয়া মে তেরে তীর কা ইয়া তকদীর কা মারা হুঁ
আওয়ারা হুঁ ”
(আমি এক ভবঘুরে —
অথবা আমি দিগন্তের রেখায়, আকাশে তারার মতো,
আমার কোনো বাড়ি নেই, কোনো পরিবারও নেই,
কেউ আমাকে ভালোবাসে না।
অপর পাড়ে কারও সঙ্গে সাক্ষাতের কোনো আকাংখা নেই,
নি:সঙ্গ এক নগরী ও অজ্ঞাত এক পথের কাছে আমি প্রিয়,
আমি এক ভবঘুরে —
আমি কখনও সমৃদ্ধি লাভ করিনি, আমি ধ্বংস হয়ে গেছি,
তবুও আমি এখনও সুখের গান গাই,
আঘাতে আঘাতে আমার হৃদয় পূর্ণ, তবুও আমার চোখে আছে হাসি,
হে পৃথিবী, আমি অদৃষ্টের তীরের আঘাতে মৃত্যুবরণ করেছি।
আমি এক ভবঘুরে —–
গীতিকার হিসেবে তাঁর সতেরো বছরের জীবনে তিনি সত্তরটি ছায়াছবির জন্য নয়শ’র অধিক গান লিখেছেন এবং তাঁর বহু গান এখনও অনেকের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। তাঁর ‘সাজন রে ঝুট মাত বলো” গানের কথা মানুষকে পরকাল স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। যদিও তিনি বামপন্থী কবি ছিলেন, কিন্তু তাঁর জীবনের শেষ সময়ে লেখা এই কবিতায় পরকালে ভালো ফল পাওয়ার জন্য পৃথিবীতে সৎকর্মের হিতোপদেশ দিয়েছেন।
“সাজন রে ঝুট মাত বলো, খুদা কে পাস জানা হ্যায়,
না হাথি (হাতি) হ্যায় না ঘোড়া হ্যায়, ওহা পায়দল হি জানা হ্যায়
তুমহারে মেহেল চৌবারে, ইয়েহি রেহ জায়েঙ্গে সারে,
আকড় কিস বাত কি পিয়ারে, ইয়ে সর ফির ভি ঝুকানা হ্যায়,
ভালা কিজিয়ে ভালা হোগা, বুরা কিজিয়ে বুরা হোগা,
বহি লিখ লিখ কে কিয়া হোগা, ইয়েহি সব কুচ চুকানা হ্যায়।
লড়কপন খেল মে খোইয়া, জওয়ানি নিন্দ ভর সোইয়া
বুড়াপা দেখকর রোইয়া, ওহি কিসসা পুরানা হ্যায়।
(হে প্রিয়, মিথ্যা বলো না, আল্লাহর কাছে যেতে হবে
হাতি-ঘোড়া কিছু থাকবে না, ওখানে হেঁটেই যেতে হবে,
তোমার দুর্গ ও বড় বড় কামরা সবকিছুই রয়ে যাবে,
হে প্রিয়, এতো অহঙ্কার কিসের, এই মাথা ঝুঁকাতেই হবে।
তুমি ভালো কাজ করলে ভালো ফল পাবে, মন্দ করলে মন্দ পাবে,
শুধু খাতা লিখে লিখে কী হবে, এখানেই সব পরিশোধ করতে হবে।

আমরা শৈশব নষ্ট করেছি খেলাধূলায়, যৌবনে প্রচুর ঘুমিয়েছি,
এখণ বার্ধক্যে সেই একই পুরোনো কাহিনির পুনরাবৃত্তিতে কাঁদি।)

শৈলেন্দ্র এক কালজয়ী কবি ও গীতিকার। তাঁর রচিত “ও বাসন্তি পবন পাগল না জা রে না জা”, “খোইয়া খোইয়া চাঁদ, খোলা আসমান, আঁখো মে সারি রাত জায়েগি, তুমকো তো ক্যয়সি নিন্দ আয়েগি”, “আজ ফির জিনে কি তামান্না হ্যায়, আজ ফির মরনে কি ইরাদা হ্যায়”, “সোহানা সফর আউর ইয়ে মওসুম হাসিন” এর মতো বহু কালজয়ী গানের স্রষ্টা ১৯৬৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মারা গেছেন। সর্বশক্তিমান তাঁর পরকালীন শান্তি নিশ্চিত করুন।